চার বছরের শিশুকন্যা তানজিনাকে বাবা কোথায় জিজ্ঞেস করলে সে বলে ওঠে, ‘আব্বা আল্লাহর বাড়ি গেছোইন, আমরার লাগি পোলাও লইয়া আইবা।
বাবা হারানো তানজিনার দৃষ্টিতে এখন শুধুই অজানা এক বিস্ময়ের ছাপ।
এদিক সেদিক তাকিয়ে যেন বাবার ফেরার অপেক্ষায় রয়েছে। সে হয়তো বুঝতেই পারেনি তার বাবা এখন না ফেরার দেশে চিরঘুমে রয়েছেন। বাবার কথা চিন্তা করে বার বার মুর্চা যাচ্ছে চার বছরের ছোট্ট এই শিশুটি। রাফি মিয়া (২) নামে এক ভাই ও আয়েশা বেগম (৮) নামে তানজিনার এক বোন রয়েছে।
তানজিনার বাড়ি মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের হরিপুর গ্রামে। তার বাবার নাম মো. আতিক মিয়া (৫৪) ও মায়ের নাম রফনা বেগম (৩৮)। গত মঙ্গলবার (২৪ নভেম্বর) ভোরে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তার বাবা আতিক মিয়া মারা যান। মৃত্যুর সময় আতিক মিয়া স্ত্রী রফনা বেগমসহ তিন সন্তানকে রেখে যান।
সদ্য প্রয়াত বাবাকে হারিয়ে তিন শিশু এখন অকূল পাথারে পড়েছে। একমাত্র মা ছাড়া পরিবারে তাদের এখন আর কেউ নেই। আত্মীয়-স্বজনরাও গরিব। এ অবস্থায় ওই তিন শিশুর ভরণপোষণের কী হবে, তা নিয়ে ভীষণ চিন্তায় আকুল হচ্ছেন স্বজন ও প্রতিবেশীরা। সরেজমিনে আতিক মিয়ার বাড়িতে গেলে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যটি চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
বাবাকে হারিয়ে ওই তিন শিশু এখন অসহায় হয়ে পড়েছে। তাদের কান্না যেন আর থামছে না। বাবাকে হারিয়ে তারা বিলাপ করছে, অবুঝ এই শিশুদের সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষাও নেই স্বজন-প্রতিবেশীদের।
এই শিশুরা এখন কীভাবে কোথায় থাকবে, তাদের ভবিষ্যৎ কী হবে এ নিয়ে এখন তাদের স্বজন-প্রতিবেশীরা চিন্তিত। শিশু তিনটির কান্নায় চোখ ভিজে উঠছে তাঁদেরও। ভারী হয়ে উঠেছে চারপাশের পরিবেশ।
সরেজমিনে দেখা যায়, তাদের মাটির ঘরের জীর্ণ দেয়াল ধসে যাওয়ার উপক্রম এবং টিনের চালাও নষ্ট হয়ে গেছে দীর্ঘদিন থেকে। বিশাল ছিদ্র হয়ে গেছে টিনের চালায়।
ঘরে নেই কোনো বিছানা, তাই মাটির মেঝেতে সন্তানদের নিয়ে শীতের এই প্রকটের সময় রাত্রীযাপন করছেন রফনা বেগম। স্বামী আতিক মিয়ার রেখে যাওয়া জীর্ণঘরসহ ছোট্ট একটি ভিটে ছাড়া আর কিছু নেই। স্বামী মারা যাওয়ার দিন ঘরে কোনো খাবার ছিল না। গ্রামের মানুষের দেওয়া সহযোগিতায় সন্তানদের আহার জুটে।
আতিক মিয়ার স্ত্রী রফনা বেগম পরিবারের একমাত্র উপার্জন সক্ষম ব্যক্তিটিকে হারিয়ের দু’চোখে শুধুই অমানিষার অন্ধকার দেখছেন। মাথার ওপরের বিশাল আকাশটা যেন হঠাৎ ভেঙে পড়ল। যা কিছু জমানো স্বপ্ন-আশা, এক নিমিষেই সব ভেঙে চুরমার হয় গেল।
এক অনিশ্চয়তার চাদরে মোড়া দীর্ঘশ্বাস নিয়ে তিনটি অবুঝ শিশুকে বুকে জড়িয়ে চোখের জল ফেলে বার বার মূর্ছা যাচ্ছেন তিনি। তাঁর শুধু আহাজারি তিনটি অবুঝ শিশুকে কিভাবে খাওয়াবেন, ভাঙা ঘরে কিভাবে থাকবেন, ভবিষ্যত কি হবে?
আতিক মিয়ার বড় ভাই এলাই মিয়া ও প্রতিবেশীরা জানান, আতিক মিয়া খুবই দরিদ্র ও সহজ সরল ছিলেন। দিনমজুর হিসেবে রাজমিস্ত্রির কাজ করে কোনোমতে সংসার চালাতেন।
কিন্তু মহামারি করোনার থাবায় কোনো কাজ না থাকায় বেকার হয়ে যান তিনি। এসব দুশ্চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। গত এক মাস ধরে হৃদরোগে (হার্টের ছিদ্র) আক্রান্ত হন তিনি। টাকার অভাবে চিকিৎসাও করাতে পারেননি।
অবশেষে গত মঙ্গলবার শিশির স্নিগ্ধ ভোরবেলায় না ফেরার দেশে পাড়ি জমান তিনি। তিন অবুঝ সন্তানকে নিয়ে জরাজীর্ণ ঘরে খেয়ে না খেয়ে মানবেতর দিন কাটছে আতিক মিয়ার স্ত্রী রফনা বেগমের।
আতিক মিয়ার রেখে যাওয়া স্ত্রী ও এতিম সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে মানবিক কারণে সরকার কিংবা সমাজের বিত্তশালীদের এগিয়ে আসার আহবান জানিয়েছেন আতিক মিয়ার বড় ভাই এলাই মিয়া ও প্রতিবেশীরা।
সদ্যপ্রয়াত আতিক মিয়ার স্ত্রী রফনা বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী অসুস্থ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। টাকার অভাবে তাকে উন্নত চিকিৎসা করাতে পারিনি। তাঁর কষ্টার্জিত উপার্জন দিয়ে আমাদের পরিবার দুঃখ-কষ্টের মধ্যে দিয়ে কোনোমতে চলছিল। কিন্তু এখন আমার স্বামীর অবর্তমানে তিন বাচ্চাদের নিয়ে ভীষণ দুঃশ্চিন্তায় আছি।
কিভাবে এই সংসার চালাব আর বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ গড়ব। এখন যদি সরকার ও সমাজের বিত্তশালী হৃদয়বান ব্যক্তিরা আমাদের সাহায্য এগিয়ে আসেন তাহলে খুবই উপকৃত হব এবং আমার বাচ্চাদের জন্য একটা কিছু করতে পারব।
বিষয়টি কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এটিএম ফরহাদ চোধুরীর নজরে আনলে তিনি বলেন, ‘আপনার মাধ্যমে ওই পরিবারের মানবেতর জীবনযাপনের বিষয়টি জেনেছি। সরেজমিন ওই পরিবারের খোঁজ নিয়ে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে রফনা বেগমকে বিধবা ভাতার আওতায় আনা হবে।
এছাড়া তার জরাজীর্ণ ঘরের বিষয়ে আমাদের গৃহনির্মাণ প্রকল্প চলমান আছে জমি আছে ভূমি নেই এই প্রকল্পের আওতায় গৃহনির্মাণের ব্যবস্থা করা হবে এবং সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সাহায্য সহযোগিতা করা হবে। সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তশালীদের এগিয়ে আসারও আহবান জানান তিনি। সূত্র কালের কণ্ঠ।